নির্বাচনোত্তর উপদেষ্টা পরিষদ |
সবার দৃষ্টি এখন নির্বাচনের দিকে। কেটে যাচ্ছে সংশয়ের মেঘ। প্রার্থীরা
গণসংযোগ নিয়ে ব্যস্ত, ভোটাররা মগ্ন কাকে ভোট দেবেন সেই হিসাবে। এই যে
দু দুটো বছর রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদ দেশটাকে চালালো, তা নিয়ে এখন
আর কেউ কথা বলতে চাইছেন না। সংস্কার, মাইনাস টু, সমঝোতার সরকার, সব
জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এই মুহুর্তে টক অফ দা কান্ট্রি হচ্ছে
নির্বাচনে কে হারবেন কে জিতবেন সেটি। এরকম একটি উৎসবের আমেজে দেশবাসীর
সাথে আমরা প্রবাসীরাও আপ্লুত। তবু কোথাও যেন একটু কষ্ট। কারণ বোধহয়
ভোটাধিকার না পাওয়া, প্রবাসী হিসেবে স্বদেশের সরকার নির্বাচনে জড়িত
থাকতে না পারার একাকীত্ব। আমরা প্রবাসীরা চিরকাল একটু একা, প্রবাসে
অবহেলিত-স্বদেশে বিস্মৃত। অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম গত দুই
বছর। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে গত দুই বছর সবচেয়ে
সোচ্চার ছিলেন প্রবাসী জনগন। তও্বাবধায়ক সরকার আসার পরে, দেশের বিভিন্ন
রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকে দুর্নিতী ও অনিয়মের অভিযোগে কারাগারে প্রেরণ
করা হলে প্রবাসীরা তাতে অকুন্ঠ সমর্থন জানান। পরবর্তীতে ঢালাও ভাবে
গ্রেফতার শুরু হলে, সর্বপ্রথম প্রতিবাদি হয়ে ওঠেন প্রবাসীরাই।
বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান স্বীকৃত হয়ে
আসলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবাসীদের গুরুত্ব দেওয়ার ধারাটি তৈরী হয়েছে
সম্প্রতি। তার পিছনে যেমন রয়েছে বাংলাদেশের এক-এগারোর প্রেক্ষাপট,
তেমনি আছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, নয়-এগারো ও তার পরবর্তী ঘটনাবলী।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ঠেকানোয় ব্যর্থতার একটি প্রধান কারণ হিসেবে
চিহ্নিত করা হচ্ছে আক্রান্ত দেশগুলির গোয়েন্দা বিভাগের তথ্যের
স্বল্পতাকে। যে কারণে, উন্নত দেশগুলিতে গোয়েন্দা বিভাগের পাশাপাশি
অন্যান্য সূত্র, যেমন প্রবাসী কম্যুনিটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে গুরুত্ব
দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে এক-এগারোর পরিবর্তন দেশকে সীমাহীন নৈরাজ্য থেকে
রক্ষা করলেও থমকে যায় গণতন্ত্রের চাকা, উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে অনেক
গণতান্ত্রিক দেশ। সে সময়, প্রবাসীরা (বা অভিবাসীরা) কি বলছেন তা
গুরুত্ব পায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় দেশ সমূহ, অষ্ট্রেলিয়া,
জাপানের মত দেশগুলির রাজনীতিবিদদের কাছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারও
প্রবাসীদের মতামতের গুরুত্ব উপলদ্ধি করে তাঁদের সমর্থন লাভের উদ্যেশে
হাতে নিতে থাকে নানা কর্মসূচী। দুই হাজার সাত সালে প্রবাসীদের নিয়ে
ঢাকাতে প্রথমবারের মত আয়োজিত, এন-আর-বি সম্মেলন ছিলো এ রকম একটি
প্রয়াস। তও্বাবধায়ক সরকারের অনেক উপদেষ্টা বিদেশ সফরকালে প্রবাসীদের
সাথে সাক্ষাৎ করে অস্থায়ী সরকারটির পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালান।
এক পর্যায়ে প্রবাস থেকে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও চলে।
আওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সহ অনেক রাজনৈতিক নেতার বিদেশ গমণ ও
অবস্থানের কারণেও লাইম লাইটে চলে আসেন প্রবাসীরা।
বর্তমানে সেই আলোটি প্রবাসীদের কাছ থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে।
নির্বাচন সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হলে বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ও
সেনাবাহিনীর উপর থেকেও সেটি দূরে সরে যাবে। তবে সে আলোয় আবারো অতীতের
রাজনৈতিক বিদ্বেষ বা দেশব্যাপী নৈরাজ্য প্রকট হয়ে ওঠে কি না তা নিয়ে
সবাই শঙ্কিত। এই শঙ্কার কারণেই সংস্কার, মাইনাস বা প্লাস ধরণের তত্ত্ব
নিয়ে এত কথা হয়েছে, নানান আঙ্গিকে পরীক্ষা নিরিক্ষা চলেছে । কোনটাই
টেকেনি, কারণ স্থিতিশিলতার জন্য যে ধারণাগুলি বার বার দেওয়া হয়েছে তা
ছিল গণতন্ত্রের বিকল্প, গণতন্ত্রের সম্পূরক নয়। রাষ্ট্রপতি দেশের একটি
দুর্বিসহ সময়ে উপদেষ্টাদের নিয়ে তও্বাবধায়ক সরকার গঠন করলে
স্বাভাবিকভাবেই সেটাকে মনে হয়ছে মন্দের ভালো একটি সাময়িক বিকল্প। দেশের
সার্বিক মঙ্গলে এ রকম একটি বিকল্প যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সহায়ক হয়ে
উঠতে পারে সে ধারনা গড়ে ওঠেনি। নির্বাচনী প্রচারণার তোড়ে নানাভাবে
অভিযুক্ত হয়ে সেই বিকল্পটি এখন বিলুপ্ত ও বিস্মৃত হবার দ্বারপ্রান্তে,
তবু একটি প্রশ্ন কিন্তু থেকে যাচ্ছে। রাষ্ট্রপতি যদি দু দুটি বছর
উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে দেশটিকে চালিয়ে নিতে পারেন তা হলে দেশের
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর কি একটি উপদেষ্টা পরিষদ থাকতে পারে না?
অপরাধ নেবেন না, আমি বর্তমানের এই উপদেষ্টা পরিষদের কথা বলছিনা, আমি
বলছি পদ্ধতিটির কথা। প্রধানমন্ত্রীর একটি শক্তিশালী উপদেষ্টা পরিষদ
থাকলে তা গণতন্ত্রের পরিপন্থী না হয়ে যদি সহায়ক হয়ে ওঠে, তাতে ক্ষতি
কোথায়। আমরা তো এখনো রাষ্ট্রযন্ত্রে একটি ফেইল সেফ মেকানিজম চাই, যাতে
রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে আবারো জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে না ওঠে। সেটা কি
আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে একক ব্যক্তির প্রভাব
আগের মতোই প্রবল, তবে আমরা আশাবাদী যে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে, অতীতের
পুনরাবৃত্তি আর হবেনা। এর একটি নেতিবাচক দিকও কিন্তু রয়েছে। বাংলা
প্রবাদ, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। আশেপাশের সবাইকে সাধু
ভেবে অতীতে দেদার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে জানা গেছে, আশেপাশে সবাই সাধু নয়
অনেক চোরও আছে। ফলশ্রুতিতে, ভুল করার ভয়ে সিদ্ধান্ত এড়িয়ে যাওয়া এবং
তার ফলে সৃষ্ট নতুন ভুলের সম্ভাবনা কিন্তু থেকে যাচ্ছে। এ রকম
ক্রান্তিকালে যদি প্রধানমন্ত্রীর একটি উপদেষ্টা পরিষদ থাকে তা সরকারের
সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে। গণতন্ত্র চর্চায় এই যে
সম্পূরক ধারণার কথা বলছি, এটি নতুন কিছু নয়। অধিকাংশ বৃহৎ গণতান্ত্রিক
দেশগুলোর সংসদ ব্যবস্থায় এ ধরণের কাঠামো বিদ্যমান। আমেরিকা
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত সহ অনেক দেশের দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট
সংসদীয় পদ্ধতিতে উচ্চ কক্ষটি (যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট, যুক্তরাজ্যের
হাউজ অফ লর্ডস বা ভারতের রাজ্য সভা), মূলত সম্পূরকের ভূমিকা পালন করে।
আমাদের হচ্ছে এক কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা। সেটাকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট
করার প্রয়োজনীয়তা বা উপযোগিতা- ইত্যাদি বিষয়ে আমি যেতে চাইনা কারন তা
সম্পূর্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ যাতে আমার জ্ঞানের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সাধারণ
মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে আমি একটি সাধারণ সম্ভাবনার কথা বলছি। অনেকে
বলবেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, এটা নতুন কোন কথা নয় আগে ছিলো
ভবিষ্যতেও থাকবে। আমি কিন্তু অতীতের সেই উপদেষ্টা মন্ডলীর কথা নয়, এমন
একটি উপদেষ্টা পরিষদের কথা বলছি যার দিকে তাকালে গণতান্ত্রিক দেশ
সমূহের উচ্চকক্ষের কার্যক্রমের কথা মনে পড়বে। যার দিকে তাকিয়ে এই ভেবে
আমরা স্বস্তি বোধ করবো যে দেশে আবারো রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দিলে
অন্ততপক্ষে বিকল্প নিয়ে ভাবতে হবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার উল্লাসে যে কোন
অধ্যাদেশ ঢালাও ভাবে গৃহীত বা বর্জিত হবার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ অবস্থান
থেকে কথা বলার কেউ থাকবে। প্রশ্ন উঠবে এ ধরণের একটি উপদেষ্টা পরিষদ
কাদের নিয়ে গঠিত হবে। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য, যেহেতু রাজনৈতিক দল
সরকার গঠন করে, তাই উপদেষ্টা পরিষদে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত
করা যেতে পারে। যেমন ডঃ ইউনুসের মত ব্যক্তিত্ব। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে
এ ধরণের ব্যক্তিত্বকে সরাসরি সম্পৃক্ত করা গেলে তাতে আমরা উপকৃত হবো।
বিভিন্ন বিষয়ে বিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের এ পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা
যেতে পারে।
এবারে শুরুর সেই প্রবাসী প্রসঙ্গটিতে ফিরতে চাই। বর্তমানে বিশ লক্ষেরও
অধিক প্রবাসী নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। দেশ গঠনে, অর্থ প্রেরণ ও
বিনিয়োগের বাইরে এদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার তেমন অবকাশ নেই। অথচ,
পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এদের অনেকেই বসবাসরত দেশে
যথেষ্টপ্রভাবশালী এবং অনেকের চিন্তা চেতনায় রয়েছে মেধা ও মৌলিকতার
বিচ্ছুরণ। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস যে দায়িত্ব পালন করছে, তার পাশাপাশি
এরা যদি দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান তা নিঃসন্দেহে ফলদায়ক হবে।
দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, যাদের ভোট দেবার অধিকার পর্যন্ত নেই তাদের পক্ষে
দেশের একটি নির্বাচিত সরকারের সাথে সম্পৃক্ত হওয়াটা কঠিন। এ প্রসঙ্গে
আসন্ন নির্বাচনে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি
প্রবাসীদের প্রতি যে অঙ্গীকার করেছে তা তুলে ধরছি। দুই দলই, প্রবাসীদের
ভোটাধিকার ও বিনিয়োগের সুযোগ করে দেবার অঙ্গীকার করেছে। এর বাইরে,
আওয়ামীলীগ প্রবাসীদের মেধার সদ্ব্যবহারের জন্য পরামর্শক নেটওয়ার্ক গড়ে
তোলার ঘোষণা দিয়েছে। অপর দিকে, বি এন পি দিয়েছে জাতীয় উন্নয়নের প্রয়াসে
প্রবাসী বাংলাদেশীদের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করার ঘোষণা। প্রবাসীরা উভয়
দলের এই অঙ্গীকারকেই স্বাগত জানায়। তবে তার বাস্তবায়ন এবং বিশ্বে
বাংলাদেশের ইতিবাচক ইমেজ গড়ে তুলতে, একটি বিন্যাসিত উপদেষ্টা পরিষদ গঠন
ও তাতে প্রবাসী প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে
পারে। |
প্রাচ্যের আন্তর্জাল পত্রিকা অভিবাস www.japanbangladesh.com |