নভেম্বর ১৬, ২০০৮, রবিবারঃ  অগ্রহায়ণ ২, ১৪১৫

!!মুক্ত চিন্তা!!

প্রবাস সিনেট

            পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী প্রবাসীদের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। এ সব প্রবাসীরা কর্মজীবনে নানা পেশায় ছড়িয়ে থাকলেও সামাজিকতার ক্ষেত্রে সঙ্গবদ্ধ হতে চেষ্টা করেন, যে কারণে গড়ে ওঠে সংগঠন। একমুখী একটি সংগঠন নয় বহুমুখী বিভিন্ন সংগঠন। আমাদের তুলনায় ভারতীয় প্রবাসীদের সংখ্যা দেশেদেশে কম নয় বরং অনেক বেশী। নানা সংস্কৃতি ও ভাষায় বিভিক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে কিন্তু এত বেশী সংগঠন গড়ার প্রবণতা দেখা যায় না। পাকিস্তানী প্রবাসীদের মধ্যে সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে একটি মসজিদমুখী প্রবণতা চোখে পড়ে। তবে পাকভারত উপমহাদেশ এমন কি অন্য কোন দেশের প্রবাসীদের মাঝে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রবনতা তেমন দেখিনি। সে তুলনায় আমাদের প্রবাস জীবনে রয়েছে রাজনৈতিক সংগঠন সহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাদারী, আঞ্চলিক - হাতে গুণে শেষ করা যায় না এমন অসংখ্য সংগঠন। আমার এ নিবেদন প্রবাসের সংগঠনের আপাদমস্তক ব্যবচ্ছেদ, নতুন নির্মাণ বা পুরাতনকে বর্জন করা নিয়ে নয়। আমি মনে করি সংঙ্গবদ্ধ হওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সেই আদি যুগে নিকষ কালো রাতে, গুহাবাসী মানুষটিকে যখন বাঘে টেনে নিয়ে যেত, তখন থেকেই শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়োজনে মানুষ সংঙ্গবদ্ধ হতে শুরু করেছে। একটি অচেনা পরিবেশ বা অজানা পরিস্থিতর সম্মুখীন হলে মানুষ একত্রিত হয়ে শক্তিশালী হবার চেষ্টা করবে সেটাই স্বাভাবিক। সমস্যা হচ্ছে, প্রবাসে আমাদের সংগঠিত হবার ক্ষেত্রে সেই প্রয়োজনটি পরিষ্কারভাবে চোখে পড়ে না। ইদানীং বাংলাদেশে ঐক্যমত কথাটি বহুল আলোচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে সবাই মিলে অভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানোর আন্তরিকতা তেমন নেই। এব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন ধারণাও দানা বাঁধছে না। দেশে নানা মত নানা পথের কারণে একতা হয়তো না হতে পারে, প্রবাসে কিন্তু সব মত আর পথের শেষে রয়েছে একটি অভিন্ন গন্তব্য, যার নাম মাতৃভূমি বাংলাদেশ।

 

            ছেলেবেলায় আমার সাঁতার শেখা পাড়ার পুকুরে, মামার কাছে। মামা বলেছিলো- আমাকে আলগাভাবে আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা কর জাপ্টে ধরিস না, তাহলে দুজনকেই ডুবে মরতে হবে। প্রবাসের সংগঠনগুলি দেখে, আলগা ভাবে আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকার চেষ্টায় জাপ্টে ধরে ডুবিয়ে এবং ডুবে মরার সেই কথাটি অনেক সময় মনে পড়ে যায় । দেখি, প্রবাসে যুথবদ্ধতার নামে আমরা অসংখ্য খন্ডচিত্র জাপ্টে ধরে আছি, সব নিয়ে একটি সমন্বিত কোলাজ চিত্র চোখে ভাসছে না। জাপান প্রবাসে একজন কম্যুনিটি সংগঠক হিসেবে অভিজ্ঞতার আলোকে আমি সেই কোলাজ চিত্র সম্পর্কিত নিম্নোক্ত ধারণা বা কন্সেপ্টটি সর্বজনের কাছে পেশ করতে চাই।

 

            ১) প্রবাসে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্য, বাংলাদেশকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য অথবা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য যে কোন প্রবাসী সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে পারেন। প্রবাসী সংগঠনের সংজ্ঞায় চারটি মূল বিষয় বিবেচ্য। ক) সর্বনিম্ন পনেরোজন নিয়মিত সাধারণ সদস্য দ্বারা গঠিত গণতান্ত্রিক সংগঠন হতে হবে, খ) লিখিত পূর্ণ গঠনতন্ত্র ও উন্মুক্ত কার্যক্রম থাকতে হবে (যেখানে দুই দেশের আইনের পরিন্থি কোন ধারা/কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা যাবেনা বা এমন কোন ধারা/কার্যক্রম অন্তর্ভূক্ত করা যাবেনা যা দুই দেশের ভাবমূর্তির জন্য নেতিবাচক), গ) সুনির্দিষ্ট মেয়াদ সম্পন্ন সর্বনিম্ন সাত সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী পরিষদ থাকতে হবে , ঘ) প্রতি বছর কমপক্ষে একটি নিয়মিত, উন্মুক্ত কার্যক্রম/অনুষ্ঠান থাকতে হবে।

 

            ২)  প্রবাসে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারি একটি মাত্র সংগঠনের চেয়ে একাধিক বহুমুখী সংগঠন কম্যুনিটিকে অধিক বিকশিত ও উৎপাদনমুখী করে তুলতে পারে। তবে, সম্পূর্ণ অভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে একাধিক সংগঠন থাকতে পারে না। কোন সদস্য একাধিক সংগঠনের কার্যনির্বাহী পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার ব্যাপারে সংগঠনের গঠনতন্ত্রে নিষেধাজ্ঞা মূলক ধারা সংযোজন করা যেতে পারে। সংগঠনগুলির পারষ্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কাম্য। একটি সংগঠন বা তার প্রতিনিধিরা প্রতিবেশী কোন সংগঠনের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না। কোন প্রতিবেশী সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা নিন্দা প্রস্তাব কার্যকরি পরিষদের পরিবর্তে সাধারণ সভায় গৃহীত হওয়া উচিৎ।
 

            ৩) বৃহত্তর ঐক্য ও সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে, প্রবাসের সব সংগঠনগুলি নিয়ে সমন্বয় সভার আয়োজন করা যায়, যার নাম হতে পারে- প্রবাস সিনেট। সিনেট শব্দটির আদি উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ সেনেক্স থেকে, যার অর্থ বর্ষীয়ান মানুষ। আদিম রোমান সমাজে বর্ষীয়ানরাই সমাজের নীতি নির্ধারণ করতেন। এই ঐতিহ্য শুধু ইউরোপ নয়, পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একটি সংগঠনে ব্যক্তির বয়সে হেরফের থাকলেও, সাংগঠনিক কর্মকান্ডে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মী অর্থাৎ বর্ষীয়ানরাই সংগঠনে প্রতিনিধিত্বমূলক অবস্থানে থাকেন। সেই সূত্রে, প্রবাসী সিনেটের সভায় প্রতিটি সংগঠনের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক বা সমপর্যায়ের দুইজন করে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ নিতে পারেন। এ ধরণের সভা বছরের প্রধান চারটি ঋতুতে চারবার আহবান করা যেতে পারে। সভা আহবান ও সঞ্চালন করার দায়িত্ব পর্যায়ক্রমে (ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে) সংগঠনগুলি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে পারে। প্রবাস সিনেট নিজে কোন সংগঠন নয়।

 

            ৪) প্রবাস সিনেট নিম্নোক্ত বিষয়ে সমন্বয় সাধন করতে পারেঃ

                ক) বিভিন্ন সংগঠনের সঠিক রূপরেখা একে অপরের কাছে তুলে ধরা। যেমন সংগঠনের চরিত্র, কার্যক্রম, সদস্য সংখ্যা, কার্যনির্বাহী পরিষদের কাঠামো-মেয়াদ। সিনেট সভায় তিন চতুর্থাংশ সংগঠনের প্রতিনিধিগন অনুমোদন করেনা এমন সংগঠন অংশগ্রহণ করতে পারবে না। সিনেট সভায় তিন চতুর্থাংশ সংগঠনের প্রতিনিধিগন যদি কোন বিশেষ ব্যক্তি সম্পর্কে আপত্তি জানায় তবে সে ব্যক্তি কোন সংগঠনের প্রতিনিধি হলেও সভায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। 

                খ) বিভিন্ন সংগঠনের প্রধান বাৎসরিক কার্যক্রমের (আনুমানিক তারিখ, স্থান) সমন্বিত ঘোষণা দেওয়া, যাতে বৃহত্তর প্রবাসী জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ সম্ভবপর হয়। পক্ষান্তরে একই তারিখে, একই সময়ে বা একই স্থানে একাধিক অনুষ্ঠান ও তার ফলে সৃষ্ট সংকট পরিহার করা।

                গ) প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্প, ঝড়, দুর্ঘটনা, যেখানে পরষ্পরের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করা দরকার সেখানে সংগঠনগুলির মধ্যে পুর্বপরিকল্পিত কমিউনিকেশন চেইন নির্ধারণ করা ও প্রয়োজন পড়লে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া।

                ঘ) স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের কার্যক্রমে প্রবাসীদের আহবান জানালে সেক্ষেত্রে প্রবাসী সংগঠনগুলির চরিত্র ও কর্মপরিধি অনুযায়ী উপযোগী সংগঠনটিকে সামনে এগিয়ে দেওয়া।

                ঙ) জাতীয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ দূতাবাস বা সমপর্যায়ের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রবাসী সংগঠনগুলিকে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে সকল সক্রিয় সংগঠনের অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করা।

                চ) বিদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করলে তার সমন্বিত প্রতিবাদ করা।

                ছ) প্রবাসী সংবাদ মাধ্যমগুলির নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনা নিশ্চিত করা ও সম্মিলিত ভাবে হলুদ সাংবাদিক ও মিডিয়া মাফিয়াদের প্রতিহত করা।

                জ) প্রবাসী কম্যুনিটিকে দালালদের দৌরাত্ম থেকে মুক্ত রাখার ব্যাপারে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া।

                 ঝ) যে সকল ব্যক্তি প্রবাসে কম্যুনিটি বিরোধী বা দেশ বিরোধী কথাবার্তা বা কার্যকলাপে লিপ্ত, তাদের চিহ্নিত করা ও প্রতিহত করার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

 

            ৫) স্থানীয় এবং বাংলাদেশী সরকারী বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রবাস সিনেট ও তার ভূমিকা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া যে আপামর প্রবাসীরা নানা সংগঠনে বিভিক্ত থাকলেও সঠিক সমন্বয়ের মাধ্যমে নিজস্ব নীতে নির্ধারণ ও বৃহত্তর ঐক্য বজায় রাখতে সক্ষম। সংগঠনগুলির কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারী বা বেসরকারী সহযোগিতা অপরিহার্য, তবে কোন সংগঠনের অভ্যন্তরীন বিষয়ে আযাচিত হস্তক্ষেপ অভিপ্রেত নয়। প্রবাস সিনেটের সভায় প্রয়োজনবোধে দূতাবাস সহ, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে আহবান জানানো যেতে পারে।

 

            ৬) সরকারী বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে অনিয়ম বা দুর্নীতি পরিলক্ষিত হলে তা উপযুক্ত স্থানে (যেমন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অথবা বাংলাদেশের পররষ্ট্র মন্ত্রনালয়, প্রবাসী কল্যান মন্ত্রনালয়, দুর্নীতি দমন ব্যুরো) জানানোর বাপারে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া। 

 

            ৭) প্রবাসে যে সকল বিষয়ে মতবিরোধ বা মতভেদ রয়েছে, সে সব ক্ষেত্রে সংঘাত এড়াতে আলোচনার টেবিলে বসা বা বসানো ।

 

            বাংলায় একটি প্রবাদ আছে- দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ। বাস্তবতা এই যে, আমাদের পক্ষে দশজনে মিলে কাজ করাটা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠেনা। তবে আমার মনে হয়, তার জন্য একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েও খুব একটা লাভ হয়না। বরং সেই বিভক্তির সুযোগ নিয়ে কিছু সুবিধাবাদি লোক মাঝখান থেকে ফায়দা লোটে। প্রবাসে একের পর এক দল ভাঙ্গা বা গড়ার পিছনে এটিও একটি অন্যতম কারণ। আর একটি ভাবকথার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই- বিদেশের মাটিতে একজন প্রবাসীই দেশের জন্য শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদূত। প্রবাসে সবাই দেশের জন্য কিছু না কিছু করতে চান। এটা খুব ভাল কথা। আমাদের সমস্যা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কথাগুলোকে আমরা কাজে রূপ দিতে পারিনা। বর্তমানে দেশে দেশে প্রবাসীদের যে অজস্র সংগঠন গড়ে উঠছে, তা হয়তো সময়ের প্রয়োজন। সময়ই বলে দেবে এগুলো টিকবে কি টিকবে না। এখন আমাদের যেটা করা উচিৎ তা হলো, সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে এই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করা। ত্রিশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্ধেকটা ভূ-উষ্ণায়ণের কারণে ডুবে যেতে পারে। আমাদের একে অপরকে আলগা ভাবে আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকা শিখতে হবে।

ডঃ শেখ আলীমুজ্জামান
লেখক ও গবেষক