৭ই জুন ২০০৮, শনিবারঃ  জ্যৈষ্ঠ ২৪, ১৪১৫

!!মুক্ত চিন্তা!!

 প্রবাসে পহেলা বৈশাখ ও আমাদের ফুড কালচার

 

পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে প্রতি বছর টোকিওতে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। এ বছর বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়, ২০শে এপ্রিল, ২০০৮, রবিবার। টোকিওর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নিশিগুচি পার্কে এই মেলাটি হয়ে থাকে। পার্কে শহীদ মিনার রয়েছে, যে কারণে প্রাবাসীরা  পার্কটির নাম দিয়েছেন শহীদ মিনার পার্ক। সকলের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়, প্রতিবছরের মতই অত্যন্ত সফল ভাবে সম্পন্ন হয়েছে এ বছরের অনুষ্ঠান। মেলার দিনে পার্কে তিল ধারণের স্থান ছিলনা। জাপানের প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, সংসদ সদস্যা ইউরিকো কোইকে এসেছিলেন মেলায়। তিনি তো বলেই বসলেন,  মনে হয় যেন বাংলাদেশে আছি!

অন্যান্য দেশের বৈশাখী মেলার সাথে এই মেলার একটি পার্থক্য রয়েছে। প্রচুর জাপানীরা আসে এই মেলায়। বাংলাদেশের সংস্কৃতি দেখে অভিভূত হয়, উপভোগ করে। মেলার আর এক বৈশিষ্ট্য হলো এর সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে কারি ফেস্টিভ্যাল। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের ফূড কালাচারকে জাপানীদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।  এ বছরের টোকিও বৈশাখী মেলায় খাবারের ষ্টল ছিলো বাইশটি। সব দোকানে দেশী খাবার। ঝাল-মুড়ি থেকে বিরিয়ানী- সবই ছিলো এ সব ষ্টলে।

মেলায় এসেছে স্থানীয় টেলিভিশন। কথাবার্তায় বুঝলাম, বাংলাদেশ ও বৈশাখী মেলা সম্পর্কে রীতিমতো পড়াশুনা করে এসেছে। যে জাপানী মেয়েটি মেলার রিপোর্ট করবে, তার পরণে লাল-পেড়ে সাদা শাড়ী। এসে ভাঙ্গা বাংলায় শুভ নববর্ষ জানালো। প্রশ্ন, কোন ফুড ষ্টলে ভাল পান্তা-ইলিশ আছে তা বলতে হবে কারণ সেটার উপর ভিত্তি করেই সে রিপোর্ট তৈরী করবে। প্রশ্নটি সঙ্গত। কিছুদিন আগে, জাপানী ওয়েব পেজগুলোতে বৈশাখী মেলা সার্চ করতে গিয়ে আমিও দেখেছি পহেলা বৈশাখের খাবার হিসেবে পান্তা-ইলিশের উল্লেখ রয়েছে। এমনকি একটি জাপানী ওয়েব সাইটে মাটির সানকিতে পান্তাভাত আর কলার পাতার উপরে ভাজা ইলিশ মাছের ছবিও দেওয়া আছে। আমি বিপদে পড়ে গেলাম। মেলা ঘুরে দেখেছি, কোন দোকানেই পান্তা-ইলিশ নেই। থাকার কথা নয়, কারণ সবাইকে আগেভাগে বলে দেওয়া হয়েছে, মেলায় বাসী খাবার বিক্রয়ের উপরে পার্ক কতৃপক্ষের নিষধাজ্ঞা রয়েছে। তাছাড়া, ভাজা ইলিশ খেতে হলে হাত দিয়ে কাটা বেছে খেতে হবে, যা বিদেশে, এরকম একটি মেলায় সাস্থ্য সম্মত ভাবে সমাপন করা দুরূহ।

     আমি বললাম, পান্তা-ইলিশ নেই, তবে পিঠার ষ্টল আছে, তুমি সেখানে যাও। বৈশাখী মেলা, অথচ পান্তা ইলিশ নেই! মেয়েটি হতাশ হয়। তবে নাছোড় বান্দা সে। বেশ, তুমিই তাহলে পান্তা ইলিশ সম্পর্কে কিছু বলো, কামেরা তাক করা হয় আমার দিকে। শুরু হয় প্রশ্নবান। এই যে তোমরা ইলিশের ফ্রাই করো নববর্ষে, এটা জাপানের নববর্ষের সাথে বেশ মিল রয়েছে। কারণ জাপানেও নববর্ষে বিশেষ মাছ ভাজা খাওয়ার রীতি আছে। জাপানে নববর্ষের (পহেলা জানুয়ারী) খাবারকে বলা হয় ও-সেচি রিওরি। এতে কয়েক প্রকার মাছ থাকে। ভাজা যে মাছটি থাকে তার জাপানী নাম বুরি (ইয়েলো টেইল)। এই বুরি মাছটি যখন পোনা অবস্থায় থাকে তখন তাকে বলা হয় ওয়াকাশি অথবা সুবাছু। তবে পোনা গুলোকে নববর্ষের খাবারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়না, করা হয় তার পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠা সংস্করণ।  বড় হয়ে ওঠা বুরি মাছ নববর্ষের খাদ্যসম্ভারে অন্তর্ভুক্ত করার কারণ, যে খাবে  সেও যেন মাছটির মতো পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠে।

-তা, বাংলাদেশের ইলিশের বেলাতেও কি কথাটি প্রযোজ্য? ইলিশ মাছতো ডিম পাড়ার জন্য সমুদ্র থেকে বাংলাদেশের নদীগুলোতে প্রবেশ করে। এ গুলো কি বৈশাখ মাসেই সাগর থেকে নদীতে আসে- মেয়েটির প্রশ্ন। আমি ক্যামেরার দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকি, মনে হয় ক্যামেরা নয় আমার বুকের দিকে তাক করে ধরা ওটা যেন একটি স্কাড মিসাইল।

 

আমি মনে করার চেষ্টা করি। যতদূর মনে পড়ে ইলিশের সাথে বর্ষাকালের একটি সম্পর্ক আছে। কিন্ত্বু বর্ষাকাল মানে তো আষাঢ় মাস। তাহলে বৈশাখে ইলিশভাজি এল কোত্থেকে। সংশয় কাটেনা, পাশের দু-চার জনকে জিজ্ঞাসা করি, সবার একই উত্তর,ইলিশের সীজন আরে যে মাসই হোক না কেন বৈশাখ নয়। আমরা কেউই এই বিদেশীনিকে সঠিক উত্তরটা দিতে পারিনা। কি বলবো? বৈশাখ মাসে ইলিশ নয়, সাধারণত পাওয়া যায় ইলিশের পোনা, তাও আবার সমুদ্রে। আর প্রকৃত সত্য হলো, ভাজি করার জন্য ইলিশের পোনা ধরলে, পহেলা বৈশাখ উদযাপন শ্রীঘরে হবার সম্ভাবনাই বেশী। তবে কি বলবো, আগের বছরের ইলিশগুলো পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত সংরক্ষন করা হয়ে থাকে। বলতে পারি, ইদানিং দেশে হয়তো তাই হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসবে, এটাই কি সনাতন রীতি? আমার কাচুমাচু অবস্থা দেখে মেয়েটার বুঝিবা করুণা হয়, প্রসঙ্গ পাল্টায় সে।

এই যে পান্তা ভাত, হ্যাঁ এটা জাপানেও আছে। নাম চা-জুকে। তবে প্রস্তুতি রীতি ভিন্ন, গরম ভাতেই সবুজ চা বা গরম পানি ঢেলে পান্তা করা হয়, বাসি ভাত নয়। তা, তোমাদের পান্তা ভাত কি পদ্ধতিতে তৈরী করা হয়- এবারের প্রশ্ন। পান্তাভাতের আবার পদ্ধতি আছে নাকি,  মনে মনে বলি, ভাতের হাঁড়িতে পানি ঢেলে দিলেই হলো। মুখে বলা হয়না। জাপানে নববর্ষ উদযাপনের একটি রীতি আমার মনে পড়ে যায়। জাপানে বছরের প্রথম দিনে হেঁসেলে হাড়ি চড়ানো হয়না। নববর্ষের সব খাবার তৈরী হয় আগের দিন রাত্রে। রাত বারোটার পর থেকে, এক দিনের জন্য ছুটি দিয়ে দেওয়া উনুনকে। আমার জানা নেই বাংলাদেশে এ রীতি প্রচলিত আছে কি না। তবে আমাদের পান্তা ভাতের সপক্ষে এটি একটি যোরালো যুক্তি হতে পারে। কিন্তু বলি বলি করেও কথাটি শেষ পর্যন্ত বলা হয়না, ভিন্ন কথা বলি। দ্যাখো, পান্তা-ইলিশই আমাদের বর্ষবরণের একমাত্র খাবার নয়। নববর্ষে বাংলাদেশে অনেক ধরণের পিঠা তৈরী হয়। তুমি বরং পিঠার ষ্টলটিতে যাও, সেখানে হরেক রকমের সুস্বাদু পিঠা আছে যা নিয়ে তুমি সুন্দর একটি প্রোগ্রাম করতে পারবে। আশাহত হয় মেয়েটি। ক্যামেরা গুটিয়ে চলে যায় পিঠার ষ্টলের দিকে।

 

হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কিন্ত পান্তা ইলিশের ভাবনাটা জোর করেও উচ্ছেদ করা যায়না। তুখোড় হকারের মত বারাবার তা ফিরে আসে মগজের ফুটপাতে। মেলায় বংলাদেশ থেকে এসেছেন বেশ কিছু বিদগ্ধ জন। মেলার অতিথি, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দা- কে জিজ্ঞেস করি, জিজ্ঞেস করি আরো কয়েকজনকে। কেউই পহেলা বৈশাখের ফুড কালচারের অবিচ্ছেদ্দ অংগ হিসেবে পান্তা ইলিশকে সত্যায়িত করতে রাজী নন। ওটাতো পরে এসেছে। আবহমান কাল থেকে আমাদের নবর্ষের খাবারের মেন্যুতে রয়েছে, নাড়ু, সন্দেশ, বাতাসা, মোয়া, পায়েস, পিঠা। এর সাথে লুচি, চিড়ে ভাজা, ঝালমুড়ি, চানাচুর ও থাকে। তবে এই পান্তা-ইলিশ এসেছে পরে, শহুরে নষ্টালজিয়ার ন্যাকামি থেকে। গ্রাম বাংলার শিকড়ের সাথে তার সংযোগ কোথায়!

 

বাবার কাছে শোনা একটা গল্প মনে পড়ে। ধনীর দুলাল, শহরে জন্ম, গ্রামে যায়নি কোনদিন। স্কুলের শিক্ষক ধান রচনা লিখতে দিলে সে লিখেছে ধান গাছ থেকে লম্বা তক্তা হয় আর সে তক্তা নাকি গৃহ নির্মাণে খুবই উপযোগী। ফলাফল, শিক্ষক কান ধরিয় বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন রচনা লেখককে। সেটাও অবশ্য সনাতন এক রীতি। তা হলে বর্তমানে, বাংলাদেশের এই ব্রান্ড সংকটের সময়ে, আমাদের পহেলা বৈশাখের ফুড কালচারে যারা অনায়াশে ঋতু-বিচ্যুত ইলিশ আর বাসী পান্তা জুড়ে দিলো তাদের কি হবে। আর এক্ষেত্রে আমাদের ব্রান্ডটাই বা কি হওয়া উচিৎ।

 

ডঃ শেখ আলীমুজ্জামান

জাপান প্রবাসী গবেষক ও চিকিৎসক
প্রধান সমন্বয়ক, টোকিও বৈশাখী মেলা