২৮ শে জুন ২০০৮, শনিবারঃ  আষাঢ় ১৪, ১৪১৫

!!মুক্ত চিন্তা!!

জাপানে জি এইট সামিট ও প্রবাস যাপন


      প্রধান মন্ত্রী আবে পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছে,শুনেছো । দৌঁড়াচ্ছিলাম, পায়ের পেশীতে অকস্মাৎ ছন্দ পতন, থেমে গেলাম। কে বলেছে? কন্ঠের বিরক্তি লুকানোর চেষ্টা করিনা। আমি, শিনযো আবে বলছি, কেন বিশ্বাস হয়না? পার্কের ভিতরটা আলোয় কালোয় অস্পষ্ট।দেখা যায়না, তবু ঝুঁকে পড়ে আবের মুখ দেখার চেষ্টা করি।ঘাম চকচকে রক্তাভ কপোল। ঈষৎ বিষ্ফোরিত, দুই চোখে চ্যালঞ্জ। এক পলক দেখলে বুঝতে কষ্ট হয়না, সকাল থেকে মদ গিলছে। হা হা হা, ল্যাও ঠালা সামলাও। হাসির দমকের সাথে তেড়ে আসা মদ এবং ঘামের উৎকট গন্ধ আমাকে বুলডজারের মতো ধাক্কা দেয়। সেপ্টেম্বরের রুদ্র সন্ধ্যা। ২০০৭ সালের গরমটা একেবারে জেঁকে বসেছে। জগিং ছেড়ে পার্কের বেঞ্চে বসি, আমার পাশে এসে বসে জাপানী বন্ধু আবে । বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। হোমলেস। টোকিওর ঈশান কোনে অবস্থিত এই পার্কের বাসিন্দা।  জাপানের বুদুবুদ অর্থনিতি ফেটে পড়লে, ২০০০ সালে তার ব্যবসাটা যায়। বউ ছেড়ে যায় একই সাথে। দেনার দায়ে যায় সহায় সম্পত্তি। ওসাকার মানুষ,টোকিওতে এসেছিলো ভাগ্য ফেরাতে। ফেরেনি। নিজেও ফিরতে পারেনি ওসাকায়। কেউ পরিচয় জিজ্ঞেস করলে বলে, সে এই পার্কের প্রধান মন্ত্রী। সকাল থেকে সন্ধ্যা, কাজ একটিই, মদ গেলা। আমি এই পার্কে মাঝে মাঝে হাঁটতে বা জগিং করতে আসি, সেই সূত্রে আলাপ। সম্পর্কের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বন্ধুত্ব। কিছুদিন ধরে সে বলছিলো জাপানের প্রধান মন্ত্রী যার নামও শিনযো আবে, নাকি  বেশী দিন টিকবে না। মাতালের প্রলাপ - এর বেশী কিছু ভাবি নি। আর এখন কিনা শুনতে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী আবে পদত্যাগ করেছে। তোমার কি?- আমি পালটা আক্রমণ করি। কথাটা গায়ে মাখে না সে। বাতাসে ভাসিয়ে দেয় নতুন তথ্য। পাতলা পায়খানা, প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ধমকে পেট খারাপ হয়ে গিয়েছিলো, তাই। কথাটা আমিও শুনেছি, এক সহকর্মীর কাছ থেকে। ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (সংক্ষেপে আই বি এস) এ ভুগছিলেন প্রধানমন্ত্রী আবে, কয়েক মাসেই কয়েক কেজি ওজন হারিয়েছিলেন। আর এই আই বি এস এর একটা মূল কারণ মানসিক চাপ, স্ট্রেস। তাই বলে, জর্জ বুশের ধমক! আমি আড়চোখে দেখি, নিঃশব্দে শরীর কাঁপিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসছে পার্কের স্বঘোষিত হোমলেস প্রধানমন্ত্রী আবে। সারাদিন মদ গেলার পাশাপাশি আর একটি কাজ সে খুব নিবিষ্ট মনে করে।খবর পড়ে। রেলষ্টেশন, শপিং মলগুলোর ডাষ্ট বিন থেকে কুড়িয়ে আনে তাবত সংবাদ পত্র আর  ট্যাবলয়েড। প্রথমে নাকি চাকরী খুঁজতো সংবাদপত্রের পাতায়।আসলে চাকরীর সাথে সম্পর্ক নেই এমন খবর গুলোতেই তার মনযোগ বেশী, বোঝা যায়। হেন খবর নেই যা আবে জানে না।

 

      সেদিন পার্ক থেকে ফিরে এসেও জর্জ বুশের ধমকের খোঁচাটি ভুলতে পারিনি। প্রতিদিন হেলায় ফেলায় সংবাদপত্রের পাতা উল্টে জেনেছি, প্রধানমন্ত্রী আবের কেবিনেট নড়বড়ে হয়ে গেছে, জনজরীপে তার জনপ্রিয়তা এসে ঠেকেছে তলানীতে। পদত্যাগ করার খবরে সংবাদগুলো একটু খুঁটিয় দেখি। প্রধান মন্ত্রী আবে ক্ষমতায় আসেন ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ।তার আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জুনইচিরো কোইজুমি। জাপানের অভ্যন্তরে কোইজুমির প্রধান এজেন্ডা ছিলো রিফর্ম বা পরিবর্তন। জাপানের ডাক বিভাগকে বেসরকারী খাতে হস্তান্তর করেছিলেন তিনি। বৈদেশিক নীতিতে, আমেরিকার সাথে জাপানের সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আমেরিকার সন্ত্রাস বিরোধী  অভিযানের একজন কট্টর সমর্থকি ছিলেন। তাঁর আমলেই ইরাক অভিযানে আমেরিকার পক্ষে যোগ দেয় জাপানী সৈন্যরা। সেই সূত্র ধরে, জাপানের ডিফেন্স এজেন্সীকে একটি পরিপূর্ণ মন্ত্রনালয়ে রূপ দেওয়া হয় ২০০৭ সালে। দেশের অলাভজনক বা ভর্তুকি দেওয়া প্রতিষ্ঠান গুলোকে বেসরকারী খাতে হস্তান্তর করা সত্ত্বেও ননপ্রডাক্টিভ প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়কে শক্তিশালী করাটা তখন মেনে নিতে চাননি অনেকে।

 

      কোইজুমি চিল্ড্রেনের অন্যতম হিসেবে খ্যাত, শিনযো আবে প্রধানমন্ত্রী হন ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। একটি সুন্দর জাপান গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। জাপানের বিদেশ নীতিতে আমেরিকার পরেই চীনের প্রাধান্য। পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী কোইজুমি চীনের নেতৃবৃন্দের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন না, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে জড়িত য়াসুকুনি মন্দির পরিদর্শনের কারণে। ক্ষমতায় এসে সুর পাল্টান আবে, এবং ২০০৬ সালের অক্টোবরেই যান চীন ও কোরিয়া সফরে। মনে হচ্ছিলো চীন-জাপান শীতল সম্পর্কের বরফ বুঝি গলতে শুরু করবে। কিন্তু শুরুটা ভাল হলেও তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকেনি। প্রধান কারণ হিসেবে ধারণা করা হয় মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি। ২০০৪ সালে জর্জ বুশ দ্বিতীয় বারের মত প্রেসেডেন্ট নির্বাচিত হলেও ২০০৬ সালে এসে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে ইরাক পলিসি বিপর্যস্ত।  ইরাক থেকে সম্মনাজনক ভাবে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে শুরু করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ।আর এ পরিকল্পনায় জড়িয়ে পড়তে হয়,এশিয়া মহাদেশে আমেরিকার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু জাপানকে। দীর্ঘ দিন ধরে বিশ্ব রাজনীতির ঝগড়া বিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে একটি মোটা অঙ্কের চেক লিখে পার পেয় গেছে জাপান। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইরাকের পুনর্বাসনেও আমেরিকার পরে সবচেয়ে বেশী টাকা ঢালতে হয়েছে জাপানকে। তবে এ যাত্রায় শুধু টাকা দিয়ে পার পাওয়া যায় নি। আফগানিস্তানে জ্বালানী তেল সরবরাহ, ইরাকে সেনা প্রেরণ থেকে শুরু করে সরাসরি মাঠে নামতে হয়েছে বিশ্ব বলয়ের পাওয়ার গেমে। জাপানের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে নানান সংকটে আবের জনপ্রিয়তা তখন নেমে এসেছে ৩০% এর নীচে। জাপানের প্রধান বিরোধী দল (ডিপিজে) আবের সকল পলিসিতে শুরু করেছে লাগাতার বিরোধিতা। ঠিক এরকম একটা সময়ে, ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলেন প্রধান্ মন্ত্রী আবে। ক্রমশঃ পাল্টাতে শুরু করলো প্রেক্ষাপট। মিডিয়াগলোতে নতুন ভাবে প্রচারিত হতে লাগলো আবের ভারত প্রীতির উপখ্যান।

 

      ২০০৭ সালের আগষ্ট মাসে ভারত সফর করেন প্রধানমন্ত্রী আবে। সফরকালে, ভারতীয় সংসদ অধিবেশনের বিশেষ অধিবেশনে তাকে বক্তব্য রাখার জন্য আহবান জানানো হয়, যা কিনা তার আগের বছর ভারত সফরে আসা প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকেও জানানো হয়নি। ভারতের উচ্ছসিত প্রসংশা করলেন আবে। শুধু তাই নয়, ভারত সফরকালে মহাত্মা গান্ধীর সমাধি কেন্দ্রে না গিয়ে গেলেন কলকাতায়, ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সমর নায়ক সুভাষ চন্দ্র বোসের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানাতে। তার পর, ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, ভারত মহাসাগরে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণাতীত কালের বৃহত্তম সামরিক মহড়া- মালাবার ০৭-২, যাতে এই প্রথমবারের মতো জোট বাঁধে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র,ভারত, অষ্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর। কৌতুহলের বিষয় হলো, এই সামরিক মহড়াটি হয়, ইরাক বা আফগানিস্তানের নিকটবর্তি আরব সাগরে নয়,বাংলাদেশের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে। ইরাক থেকে  যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সম্মানজনক ভাবে বেরিয়ে আসার রূপ রেখাটি ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে শুরু করে। শুরু হয় এশিয়ান ন্যাটো নিয়ে চাপা গুঞ্জন। পূর্ণ মহড়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু  মঞ্চস্থ হয় নি সে নাটক। স্বরব হয়ে ওঠে চীন। ভারতের বাম দলগুলো যুক্তরাষ্ট্র প্রীতির প্রচন্ড বিরোধিতা শুরু করে, ফলে পিছিয়ে আসেন প্রধান মন্ত্রী মনমোহন সিং। ওদিকে পট পরিবর্তনের ঘন্টাধ্বনি বেজে ওঠে অষ্ট্রেলিয়ায়। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, একটি নতুন সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার তৃতীয় দিনে, বলা নেই কওয়া নেই, পদত্যাগ করে বসেন জাপানের প্রধান মন্ত্রী শিনযো আবে। স্থলাভিষিক্ত য়াসুও ফুকুদা পরিত্যাগ করেন সুন্দর জাপানের স্বপ্ন। তার দুইমাস পরে অষ্ট্রেলিয়ার প্রধান মন্ত্রিত্ব থেকে বিদায় নিতে হয় ডানপন্থী জন হাওয়ার্ডকে, আসেন বাম পন্থী কেভিন রুড।  

 

      গত বছর টোকিওতে গরমটা যেমন ছিলো ঝাঁঝালো, শীতও ছিলো তেমনি কনকনে।  তীব্র শীতে নিয়মিত হাঁটতে বা জগিং করতে আর যাইনা আমার প্রিয় পার্কটিতে। মাঝে দু একদিন গেলেও দেখা হয়নি পার্কের স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী আবের সাথে। ২০০৮ এর এপ্রিল মাসটা কাটলো শীত না গ্রীস্ম এই সংশয়ে। তারপর জুনে সেই হিমেল হাওয়া  উত্তর মেরুতে নির্বাসিত হলে, মন শক্ত করে একদিন গেলাম পার্কে জগিং করতে। দেখি আবে পার্কের বেঞ্চে বসে বসে গান করছে, হাতে জাপানী সাকের (মদ) কাপ। আমাকে দেখেই উচ্ছসিত হয়ে উঠলো সে। এসো এসো, সাদর সম্ভাষণ জানালো। তোমাকে পুলিশে খুঁজছে কেন, আকাম-কুকাম কিছু করেছো নাকি?  আচমকা প্রশ্ন করে বসলো। আমি বিস্মিত ও চিন্তিত হই। পার্কের একজন হোমলেস মানুষের কাছে পর্যন্ত আমার মতো একজন প্রবাসী বাংলাদেশী সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে পুলিশ। ওরা জিজ্ঞেস করলো,তোমার সাথে আমার দোস্তি কেন, টাকা পয়সা পাই কিনা,- আবে বলতে থাকে। কিংবা পার্কে শুধু জগিং করতে আসো নাকি অন্যান্য বিদেশীদের নিয়ে মিটিং বা শলা পরামর্শ করো।  আমি অবশ্য ঠোলাদের  তেমন কোন উত্তর দেইনি, সাফ সাফ বিদায় করে দিয়েছি,- আবে জানায়। ওরা কি বললো জানো,ঐ জি এইট সামিট, যেটা হোক্কাইদোর তোয়াকোতে আরম্ভ হচ্ছে জুলাই মাস থেকে, ওটাই কারণ। সারা দেশ জুড়ে কড়া সিকিউরিটি। তোয়াকোর উপর দিয়ে এখন পাখীদের ওড়াও নিষেধ। জলবায়ু বিপর্যয় প্রতিরোধ, আফ্রিকার উন্নয়ন এ সবতো বৈঠক খানার আড্ডা, প্রেমালাপটা হবে বেডরূমে,- আমার কানের কাছে এসে ফিস ফিস করে বলতে থাকে আবে। উহ, কি দুর্গন্ধ আবের নিশ্বাসে! জ্ঞান দিওনা, মদ গিলছো তাই গেলো,- তাকে থামিয়ে দিয়ে আমি হালকা জগিং শুরু করি। 

      শুধু আমি নই, ইদানীং প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেককেই পুলিশী জেরার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কমিউনিটির কি খবর, কোথায় কি হচ্ছে সব বিষয়ে জানতে চায় পুলিশ। একবার দুবার নয়, নিয়মিত, প্রতিমাসেই পুলিশি তলব আসে। বিরক্ত হলে, হেসে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলে, মনে কিছু করো না, সামনে জি-এইট সামিট। সেটা শেষ হলেই আর জ্বালাতন করবোনা। আমার পরিচিত এক বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্ট মালিক সেদিন জানালেন, বাংলাদেশ থেকে রাঁধুনী আনতে ভিসা দিচ্ছে না জাপান সরকার, জি-এইট সামিট শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেবেনা।  অন্যদের কাছে জেনেছি, সামিট শেষ না হও্য়া পর্যন্ত সব ধরণের ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে প্রচন্ড কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। অনেকেই আবেদেন করে, প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র দিয়েও ভিসা পাচ্ছেন না।

 

      জি এইট এর জন্য এশিয়া তথা বিশ্বের দরিদ্র্যতম দেশ থেকে আসা বাংলাদেশী প্রবাসীদের কেন এত ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে, আমি ঠাউরে উঠতে পারিনা। এবারের সামিটের প্রধান ইস্যুগুলো হচ্ছে, বিশ্বের জলবায়ু বিপর্যয় প্রতিরোধ, আফ্রিকার উন্নয়, বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও বিশ্ব আণবিক শক্তির লাগামহীন প্রসার রোধ। সন্দেহ নেই সবগুলো ইস্যুই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু জি এইট দেশ নয় পৃথিবীর সকল দেশের, সারা মানব জাতির সম্মিলিত সমস্যা এগুলি, যা নিয়ে মূল আলোচনাটা হওয়া উচিৎ জাতিসংঘে। তবে, জি এইট অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আটটি দেশ যদি তাদের সম্মেলনে নিজের ধন-দৌলতের কথা না বলে জলবায়ু বিপর্যয় কিংবা দরিদ্য আফ্রিকার জন্য কত দান খয়রাত করা যেতে পারে তা নিয়ে  আলোচনা করতে চায়, আপত্তি নেই। এই আটটি দেশই পৃথিবীর অর্ধেক কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমণ করে।সারা পৃথিবীতে যুদ্ধ বিগ্রহে যে অস্ত্র ব্যবহৃত হয় তার ৯০% তৈরী হয় এই আটটি দেশে।পৃথিবীর মোট পুঁজির ৮০% রয়েছে এই আটটি দেশের হাতে। সুতরাং এই অঢেল বিত্তবানরা ভবের নাট্যমঞ্চে ভাগ্যনিয়ন্তার চরিত্র দাবী করতেই পারে। তবে আমরা দক্ষিন এশিয়ার মানুষ আর দয়া দাক্ষিন্যের উপর বেঁচে থাকতে চাইনা, চাই অল্প কিছু পুঁজি, পেটে ভাতে বেঁচে থাকার মতো সামান্য উপার্জন। আফ্রিকার মানুষেরাও এখন তাই বলছে। জি এইট সামিটকে সামনে রেখে জুন মাসে  জাপান-আফ্রিকা সামিট হয়ে গেল য়োকোহামাতে। জাপান যখন তার অন্যতম দোসর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরাক-আফগানিস্তান নিয়ে মহাব্যস্ত তখন চীন নীরবে কাজ করে গেছে আফ্রিকায়। শুধু ২০০৬ সালেই, আফ্রিকায় চীনের ব্যবসার পরিমান ছিলো ৫০ বিলিয়ন ডলার।আফ্রিকার দেশগুলোকে খুব সাধারণ একটা মেসেজ দিতে পেরেছে চীন। বিজনেস ইজ বিজনেস, সাহায্যের নামে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করা হবে না। জাপান-আফ্রিকা সামিটে য়োকোহামাতে আসা আফ্রিকান নেতারা স্পষ্ট বলে দিয়ে গেলেন, শুধু অর্থনৈতিক সাহায্য নামক ভিক্ষা নয়, চাই ইনভেষ্টমেন্ট, চাই বিজনেস পার্টনারশীপ।

 

      আবের একটা কথা মনে পড়ে যায়। জি এইট সামিটের ভেন্যু, তোয়াকোর উপর দিয়ে নাকি পাখি ওড়াও নিষেধ। চকিতে দেশের একটা শোনা কথা মনে পড়ে। খুলনার প্রখ্যাত এক রাজনৈতিক নেতার বাড়ীর উপর দিয়ে নাকি পাখী উড়ে যাবার সময় এক ডানা দিয়ে উড়তো (অন্য ডানা বাবহৃত হতো আব্রু ঢাকতে)।  কারণ, ঐ নেতার নাকি আলুর দোষ ছিলো! তো, তোয়াকো জায়গাটি হোক্কাইদো দ্বীপে অবস্থিত, যেখানে জাপানের তাবত আলু উৎপন্ন হয়ে থাকে। সামিটের ভেন্যুর উপর দিয়ে পাখী উড়তে না দেওয়ার কারণটাও আবার কারো আলুর দোষ নাকি! আবোলতাবোল ভাবনায় আনমনে হেসে ফেলি, জগিং থেমে যায়। তবে প্রকৃত অর্থেই, আকাশে পাখী  উড়তে না দেবার মত ক্ষমতাধর হতে চলেছে জাপান। জি এইট সামিটের জন্য এত আয়োজনের মাঝেও ঠিকই অব্যাহত রেখেছে সমরসজ্জা । জুন মাসে জাপান-আফ্রিকা সামিটের পাশাপাশি, সংসদে পাশ হয়েছে জাপানের অত্যাধুনিক সামরিক প্রকল্প, স্পেস ডিফেন্স সিস্টেম। আণবিক বোমা ঠোঁটে নিয়ে কোন মিসাইল পাখী সত্যিই যদি উড়ে আসে জাপানের দিকে, সেটা স্যাটেলাইটে বসানো লেসার কামান দিয়ে নিমেষে ধ্বংস করে দেবার মত ক্ষমতা অর্জন করা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।

 

      বেসুরো কন্ঠে, তারস্বরে গান গাইছে আবে, জাপানের একটি বিখ্যাত এনকা (লোকগীতি)- নিঃসঙ্গ নাবিক।  চলি, বলে বিদায় নিতে গেলে গান থামায় সে। বলে, আবার দেখা হবে। তবে একটা কথা, জর্জ বুশ আসবে তোয়াকো জি এইট সামিটে। তার বাপ ,সিনিয়ার বুশ, একবার জাপানে এসে  তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী মিয়াজাওয়ার গায়ে বমি করে দিয়েছিলো। এবারেও যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুই ফুয়েল- তেল আর  মদের দামের একটা ফয়সালা না হয়, তাহলে জুনিয়র বুশ বমি করে বসতে পারে, বর্তমান জাপানী প্রধানমন্ত্রী ফুকুদার গায়ে। অবশ্য সেখান থেকেই শুরু হবে নয়া যুগ এবং আমি নতুন ব্যবসা আরম্ভ করবো আফ্রিকায়, দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেয় আবে। হোমলেস এক মাতালের প্রলাপ! আমি কথা না বাড়িয়ে নীরবে বেরিয়ে আসি পার্ক থেকে। কানে বাজতে থাকে বেসুরো কন্ঠে, তারস্বরে গাওয়া গান-নিঃসঙ্গ নাবিক।

ডঃ শেখ আলীমুজ্জামান
জাপান প্রবাসী গবেষক ও চিকিৎসক